নারায়ানগঞ্জ থেকে ফিরে শহিদুল ইসলাম :
বীর মুক্তিযোদ্ধা একেএম নাসিম ওসমান তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু আগামীকাল সোমবার উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এ সেতুটি উদ্বোধন করবেন। উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীর দুই তীরের নারায়ণগঞ্জ সদর (শহর) ও বন্দর উপজেলার মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ হবে। লাঘব হবে দুর্ভোগ। সড়ক যোগাযোগে সেতুবন্ধন তৈরি হবে সদর ও বন্দর উপজেলার মধ্যে। উদ্বোধন উপলক্ষে নদীর দুই তীরের মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে আনন্দ-উল্লাস ও উদ্দীপনা। দুই তীরের মানুষের মধ্যে চলছে আনন্দের বন্যা। শনিবার বিকেলে উদ্বোধনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সেতুটির প্রকল্প পরিচালক শোয়েব আহমেদ।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জের বন্দর ও সদর উপজেলার সৈয়দপুরে বীর মুক্তিযোদ্ধা একেএম নাসিম ওসমান তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু প্রকল্পটি ২০১০ সালে একনেকে অনুমোদন পেলেও ২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি নির্মাণকাজ শুরু হয়। সেতুটি নির্মাণ করেছে একটি চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এক দশমিক ২৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ২২ দশমিক ১৫ মিটার প্রস্থ ছয় লেনবিশিষ্ট সেতুটি নির্মাণ করতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬০৮.৫৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২৬৩.৩৬ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকারের তহবিল থেকে এবং ৩৪৫.২০ কোটি টাকা সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্ট (এসএফডি) থেকে এসেছে। ওয়াকওয়েসহ সেতুটিতে ৩৮টি স্প্যান রয়েছে। এগুলোর মধ্যে পাঁচটি নদীতে এবং ৩৩টি পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত। এই সেতুটি নির্মাণের ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গে চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও সহজ হবে। এ সব রুটে পরিবহনগুলো পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-যাত্রাবাড়ী হয়ে কাঁচপুর সেতু দিয়ে চলাচল করত। কিন্তু নাসিম ওসমান তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু খুলে দেয়া হলে গাড়িগুলো বন্দর হয়ে মদনপুর দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে উঠে গন্তব্যে যাবে। এতে করে কমপক্ষে তিন ঘণ্টা সময় বাঁচবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের। একই সঙ্গে দুর্ভোগ লাঘব হবে দুই তীরের মানুষের। পূরণ হবে দীর্ঘদিনের স্বপ্ন।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, সেতুর টোল প্লাজার পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে এ্যাপ্রোচ সড়কের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। তবে সেতুর পশ্চিম প্রান্তে কিছু অংশ রাস্তার নির্মাণকাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সেতুটি উদ্বোধনের সকল প্রস্তুতি নিতে দেখা গেছে। স্থানীয়রা জানায়, শুধু দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ নয়, শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম ও পুর্বপারের মানুষের যাতায়াতের একমাত্র অবলম্বন ছিল নৌকা। এই নৌকায় যাত্রীরা পারাপার হতে গিয়ে প্রায় দুর্ঘটনা ঘটে, অনেক মানুুষের প্রাণহানি ঘটেছে। তবে তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু নির্মাণ হওয়ায় এই দুর্ভোগ বা দুর্ঘটনায় প্রাণহানি থেকে বাঁচবে উভয় পারের মানুষ। খবর নিয়ে জানা যায়, শীতলক্ষ্যা নদী বন্দর উপজেলা ও সোনারগাঁ উপজেলাকে জেলা সদর থেকে পৃথক করেছে। এ দুটি উপজেলা সরাসরি সড়কপথে জেলা সদরের সঙ্গে সংযুক্ত নয়। দুই উপজেলা থেকে জেলা সদরে যেতে কাঁচপুর ব্রিজ (শীতলক্ষ্যা-১ সেতু) ব্যবহার করতে হয়। এ জন্য সড়কপথে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরত্বের পথ অতিক্রম করতে হয়। অথচ নৌপথে এই দূরত্ব মাত্র কয়েক কিলোমিটার। বন্দর উপজেলায় বসবাসকারী হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জে কাজের জন্য নৌকায় করে শীতলক্ষ্যা নদী পার হয়। একইভাবে নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ থেকেও মানুষ নৌকায় শীতলক্ষ্যা নদী পাড়ি দিয়ে বন্দর বা সোনারগাঁ উপজেলায় আসে। নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুটি বন্দর উপজেলা ও জেলা সদরের মধ্যে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করবে।
শীতলক্ষ্যার পশ্চিম পারের সৈয়দপুর এলাকার বাসিন্দা মনির হোসেন বলেন, শীতলক্ষ্যা পূর্ব ও পশ্চিমপারের মানুষসহ সমগ্র নারায়ণগঞ্জবাসীর একটি স্বপ্ন ছিল এ সেতুটির বাস্তবায়ন। তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু চালু হওয়ার পর পূর্বপার ও পশ্চিম পারের মানুষের স্বপ্ন পূরণ হবে। খুলনা ও যশোরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ চট্টগ্রাম, সিলেট বা কক্সবাজারে বেড়াতে যান বা অন্য কোন কারণে তাদেরকে যাতায়াত করতে হয়। এতে তাদেরকে দীর্ঘপথ ঘুরে যেতে হয়। অনেক সময় তাদেরকে যানজটে পড়তে হয়। এ সেতুটি বাস্তবায়ন হওয়ায় এখন পদ্ম সেতু হয়ে মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুর দিয়ে তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু পার হয়ে কমপক্ষে তিন ঘণ্টা কম সময়ে তারা গন্তব্যে যেতে পারবেন। সাদ্দাম হোসেন বলেন, এ সেতুটি খুলে দেয়া হলে মানুষ ভোগান্তি থেকে মুুক্তি পাবে। সেতুটি চালু হলে এলাকার মানুষ অনেক উপকৃত হবে। বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সেতুটি বাস্তবায়ন করেছেন, এ জন্য শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। মোঃ পনির মিয়া জানান, সেতুটি বাস্তবায়ন হওয়ায় বন্দর ও নারায়ণগঞ্জ শহরের দুই পারের মানুষের অনেক উপকার হবে। মানুষজনকে আর শীলতলক্ষ্যা নদীতে ট্রলার বা নৌকা দিয়ে পার হতে গিয়ে আর দুর্ঘটনার শিকার হতে হবে না। বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া এলাকার বাসিন্দা মোশাররফ হোসেন বলেন, নারায়ণগঞ্জ শহরের একটি প্রতিষ্ঠানে আমি কাজ করি। প্রতিদিন শীতলক্ষ্যা নদী নৌকা দিয়ে পার হয়ে গন্তব্যে আসতে হয়। এতে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে বাধ্য হই। বিশেষ করে রাতের বেলা ও ঝড়-বৃষ্টির সময় নদী পার হতে গিয়ে নানাবিধ সমস্যায় পড়তে হয়। এখন তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুটি চালু হলে আর নৌকা দিয়ে নদী পার হতে হবে না। অপেক্ষায় আছি, কখন এ সেতুটি দিয়ে পারাপার হতে পারব।
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজ উদ্বোধনের প্রস্তুতি সভায় বলেন, সেতু উদ্বোধনের পর রাতেই ট্রাকসহ যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে সেতুটি। সেতুর পশ্চিমপাড়ে ৫০ মিটার এ্যাপ্রোচ সড়কের কাজ বাকি আছে। সেখানে বালি ও খোয়া ফেলে দ্রুত যান চলালের উপযোগী করে তোলা হবে। পরে রাস্তাটি কার্পেটিং করা হবে। সেতুটির প্রকল্প পরিচালক শোয়েব আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, আগামীকাল সোমবার সেতুটি উদ্বোধন উপলক্ষে সকল প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। আজ রবিবারের মধ্যে সকল কাজ সম্পন্ন হয়ে যাবে। গাড়ি চলাচলে কোন সমস্যা হবে না। সেতুটি ছয় লেনের। দুই লেন হচ্ছে ধীরগতির যানবাহন চলাচলের জন্য, বাকি চার লেন দিয়ে সকল ধরনের যানবাহন চলাচল করবে।